স্বদেশ ডেস্ক:
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লুইজ ইনাসিও লুলা ডা সিলভার চমকপ্রদ বিজয় বিশ্বকে বিস্মিত করেছে।
যাকে এর আগে ক্ষমতায় থাকার সময় ঘুষ নেবার অভিযোগে জেলে যেতে হয়েছিল, যার নির্বাচন করা নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল- সেই মামলা পরে আদালতে খারিজ হয়ে যাওয়া এবং তারপর আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়িয়ে পুননির্বাচিত হওয়া- একে নাটকীয় বললেও যেন কম বলা হয়।
কিন্তু ৭৭ বছর বয়সী এই বামপন্থী নেতার বেলায় তাই হয়েছে।
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দ্বিতীয় পর্বের ভোটাভুটিতে তিনি ৫০.৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট জেয়ার বলসোনারোকে হারিয়েছেন।
জনমত জরিপে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল
এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারাভিযান শুরুর সময় থেকেই জনমত জরিপগুলোতেই লুলার জয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল।
কিন্তু প্রথম দফা ভোটের পর যখন দেখা গেল যে দুই প্রার্থীর মধ্যে ভোটের ব্যবধান- যা ভাবা হয়েছিল তার চেয়ে কম তখন এ নির্বাচন নিয়ে একটা সংশয়ও তৈরি হয়েছিল।
তবে দ্বিতীয় দফার নির্বাচন শেষে দেখা যাচ্ছে লুলা ডা সিলভা ৫০.৯ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো পেয়েছেন ৪৯.১ শতাংশ ভোট।
মাত্র দুই শতাংশ ভোটেরও কম ব্যবধানে জিতেছেন লুলা।
বিবিসির বিশ্লেষক ব্রুনো ফেরেরা গার্সেজ বলছেন, লুলা ডা সিলভা বেশি ভোট পেয়েছেন ব্রাজিলের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র উত্তরাঞ্চলে, আর তরুণতর ভোটার ও নারীদের মধ্যেও তার সমর্থক ছিল বেশি।
অন্যদিকে বলসোনারোর রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল ব্রাজিলে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্বের অপেক্ষাকৃত সচ্ছল ব্রাজিলিয়ানদের মধ্যে- তা ছাড়া যারা সামাজিকভাবে রক্ষণশীল এবং খ্রিস্টান ডানপন্থী, গোঁড়া গর্ভপাত-বিরোধী এবং জাতীয় পরিচয়ের রাজনীতিরও সমর্থক।
ফেরেরা গার্সেজ বলেন, তবে দ্বিতীয় পর্বের ফলাফল দেখে মনে হয়, বলসোনারো এই পর্বে মধ্যপন্থী ভোটারদেরকে তার পক্ষে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন।
‘গণতন্ত্রের জন্য সুখবর’
ভোটের ফলাফল ঘোষণার পর বলসোনারো শিবিরে নীরবতা নেমে এসেছে। বলসোনারো নিজে, শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এখনো পরাজয় স্বীকার করেননি বা বিজয়ী লুলার সাথে কথা বলেননি।
অবশ্য তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা মিডিয়াতে যেভাবে কথা বলেছেন, তাতে ফলাফল মেনে নেবার ইঙ্গিত আছে।
সাও পাওলোর গেটুলিও ভার্গাস ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক অলিভার স্টুয়েংকেল বিবিসিকে বলেন, বিশ্ব তার প্রতিক্রিয়া শোনার জন্য অপেক্ষা করছে ঠিকই তবে একটা ব্যাপার নিশ্চিত যে তার পরাজয় ‘গণতন্ত্রের জন্য সুখবর।’
অলিভার বলেন, গত চার বছর ধরে বলসোনারো জবাবদিহিতা বিনষ্ট করার চেষ্টা করেছেন, বিচার ব্যবস্থা এবং সুশীল সমাজের ওপর চাপ বাড়িয়েছেন, বলেন তিনি।
সেদিক থেকে- বিশেষ করে বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের জন্য লুলার বিজয় দ্ব্যর্থহীনভাবেই ভালো খবর, বিশেষ করে এমন সময়ে যখন গণতন্ত্র পিছু হটছে।
কী পরিবর্তন আনবেন প্রেসিডেন্ট লুলা
লুলা এর আগে ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
সে সময় তার রাষ্ট্র-পরিচালিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক নীতিসমূহ লাখ লাখ লোককে দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্ত করেছিল।
এবারো তিনি সেই নীতিই অব্যাহত রাখবেন বলে মনে করা হচ্ছে। তবে বিবিসির বিশ্লেষকরা বলছেন, কোভিড মহামারী পরের অর্থনৈতিক অবস্থায় লুলার পক্ষে আগেকার মতো সাফল্য পাওয়া কঠিন হতে পারে।
বিশেষ করে কংগ্রেসে তার বৈরি বলসোনারোর সমর্থকরা এখনো শক্তিশালী এবং তিনি জোর বাধার সম্মুখীন হতে পারেন।
তবে একটা গুরুতর পরিবর্তন আসবে ব্রাজিলের পরিবেশ সংক্রান্ত এজেণ্ডায়- বলেন ব্রাজিলের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী এবং অ্যাড্রিয়ান আর্স্ট ল্যাটিন আমেরিকা সেন্টারের সিনিয়র ফেলো আব্রাও নেটো।
লুলা বলেন, তিনি আমাজন বনাঞ্চল উজাড়ের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন, ব্রাজিলকে বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় এক নেতৃত্বের ভূমিকায় নিয়ে যাবেন।
সেদিক থেকে বলসোনারোর পরাজয় ব্রাজিলে এবং তার বাইরেও বিশেষত পরিবেশকর্মীদের মধ্যে একটা স্বস্তি ফিরিয়ে আনবে, মনে করেন ব্রুনো ফেরেরা গার্সেজ।
দুর্নীতির মামলায় জেলে গিয়েছিলেন লুলা
সাবেক ট্রেড ইউনিয়ন নেতা এবং ইস্পাত কারখানা শ্রমিক লুইজ ইনাসিও লুলা ডা সিলভার জন্ম এক দরিদ্র পরিবারে।
২০০৩ থেকে ২০১০ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট থাকার সময় লুলার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। কিন্তু পরে তিনি এবং তার ওয়ার্কার্স পার্টির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় অর্থনৈতিক মন্দা এবং একটি দুর্নীতির মামলার কারণে।
এতে কারাদণ্ড হয়েছিল লুলা ডা সিলভার। যদিও পরে সে অভিযোগ খারিজ হয়ে যায়, কিন্তু এ কারণে ২০১৮ সালের নির্বাচনে লুলা প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করতে পারেননি। তাকে সরকারি পদের জন্য নির্বাচনে দাঁড়ানোর অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তিনি ব্রাজিলের রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানির ঠিকাদারি পাইয়ে দেবার বিনিময়ে একটি নির্মাণ কোম্পানির কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছিলেন।
এ অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়ে তিনি ৫৮০ দিন জেলে ছিলেন, তবে তারপর তার বিরুদ্ধে আনা সেই অভিযোগ খারিজ হয়ে যায় এবং তিনি রাজনীতিতে ফিরে আসেন।
বলসোনারোই প্রথম দ্বিতীয় মেয়াদে জিততে না-পারা প্রেসিডেন্ট
অন্যদিকে ডানপন্থী বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জেয়ার বলসোনারো উঠে এসেছিলেন ব্রাজিলের পার্লামেন্টের পেছনের কাতারের সদস্যদের মধ্যে থেকে।
তার রক্ষণশীল জোট এক মেয়াদে জিতলেও বিশেষত করোনাভাইরাস মহামারীর সময় ব্রাজিলে ব্যাপক মৃত্যুর কারণে ব্যাপকভাবে জনসমর্থন হারায়।
অ্যাড্রিয়েন আর্স্ট ল্যাটিন আমেরিকান সেন্টারের সিনিয়র পরিচালক জ্যাসন মারজাক বলেন, এটা এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বলসোনারোই হচ্ছেন গণতান্ত্রিক ব্রাজিলের ইতিহাসে প্রথম নেতা যিনি দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হতে ব্যর্থ হলেন।
তিনি আরো বলেন, যদিও বলসোনারো হেরেছেন খুবই কম ভোটের ব্যবধানে, তবুও একজন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় বোঝা যাচ্ছে যে ব্রাজিলের সমাজ বর্তমান অবস্থা নিয়ে স্পষ্টতঃই হতাশ এবং সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেই এর একটা অভিঘাত হবে।
বিশ্বজুড়ে ডানপন্থী-পপুলিস্টদের উত্থান কি একটা ধাক্কা খাবে?
বলা যায়, এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে পৃথিবীর অনেকগুলো দেশের নির্বাচনেই ডানপন্থী এবং পপুলিস্ট বা ‘জনতোষণবাদী’ নেতারা বিজয়ী হচ্ছিলেন।
ব্রাজিলে জেয়ার বলসোনারো জয়ী হন ওই সময়ই।
যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প, হাঙ্গেরিতে ভিক্টর অরবান, ভারতে নরেন্দ্র মোদী, ফিলিপিনে রদ্রিগো দুতের্তেসহ এ ধরনের নেতাদের বিজয়ের পর বলা হচ্ছিল যে পৃথিবী জুড়েই পপুলিস্ট নেতাদের ক্ষমতায় আসার একটা ধারা তৈরি হয়েছে।
কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয় এবং এখন বলসোনারোর বিদায় আর লুলার পুনরাবির্ভাব কি একটা ভিন্ন বার্তা দেয়?
ব্রুনো ফেরেরা বলেন, এরকম কিছু বলার সময় এখনো আসেনি। প্রথমত, লুলার জয়ের ব্যবধান খুবই সামান্য, একটু এদিক-ওদিক হলেই ফলাফল বিপরীত কিছুও হতে পারতো। তা ছাড়া জনমত জরিপ বলছে যে যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবর্তী নির্বাচনে কট্টর ডানপন্থী রিপাবলিকানরা ভালো করতে পারে, তারা ইতালিতে জিতেছে, ফ্রান্সে আরো শক্তিশালী হয়েছে, তাই ডানপন্থী পপুলিজম বিদায় নেবার পথে- এমন মনে করার এখনো কোনো কারণ নেই।
গোলাপী ঢেউ?
ব্রাজিল শুধু দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম দেশই নয়, ব্রিকস জোটেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এই দেশটি- যার আন্তর্জাতিক গুরুত্ব কম নয়।
অনেকে বলছেন, ব্রাজিলে লুলার জয়ের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় একটা ‘গোলাপী ঢেউ’ জোরদার হয়েছে।
লুলার বিজয়ের ফলে এখন মেক্সিকো থেকে শুরু করে আর্জেন্টিনা পর্যন্ত ল্যাটিন আমেরিকার প্রধান অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশগুলোয় বামপন্থীদের ধারাবাহিক সাফল্যে যুক্ত হলো ব্রাজিলের নাম।
এর কিছুকাল আগে ওই অঞ্চলের আরো দুটি দেশ কলম্বিয়া এবং চিলির নির্বাচনে বামপন্থীরা জয়ী হয়েছে এবং দক্ষিণ আমেরিকায় রাজনীতিতে যে একটা পরিবর্তন হচ্ছে তার প্রতিধ্বনি লুলার বিজয়ের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে।
তবে এটি ল্যাটিন আমেরিকার রাজনীতির বামঘেঁষা হয়ে ওঠার প্রবণতার ইঙ্গিত এমন ধারণাকে ‘অতিসরলীকরণ’ বলে আখ্যায়িত করেন মারজাক।
সূত্র : বিবিসি